নুরুদ্দীন তাসলিম
ইসলামের প্রথম যুগে আল্লাহর রাসূল সা. মক্কার বিভিন্ন গোত্র, ব্যক্তির কাছে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশই ইসলামের আহ্বান প্রত্যাখান করতো, আল্লাহর রাসূল সা.-এর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতো। মক্কার বাইরের অনেক গোত্র ও ব্যক্তিকেও ইসলাম গ্রহণ জানিয়েছিলেন আল্লাহর রাসূল। তাদের কেউ কেউ রাসূলের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। এমন একজন হলেন বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু জর গিফারি রা.।
তিনি শহর থেকে দূরে এক এলাকায় বসবাস করতেন। সেখানেই তিনি রাসূল সা.-এর নবুওয়তের ব্যাপারে জানতে পারেন। এ বিষয়টিই তাকে ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী করে তোলে।
তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বুখারি শরিফে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বর্ণনা মতে আবু জর রা. নিজেই বলেছেন—
আমি ছিলাম গেফার গোত্রের লোক। আমি শুনতে পেলাম যে, মক্কায় এমন এক ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে, যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করছেন। এ খবর শুনে আমি আমার ভাইকে পাঠালাম। তাকে বলে দিলাম, তুমি সেই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে আমাকে এসে তার বিষয়ে বিস্তারিত জানাবে।
আমার ভাই মক্কা থেকে ফিরে এসে আমাকে জানালো, আমি মক্কায় এমন একজন ব্যক্তিকে দেখেছি, যিনি সৎকাজের আদেশ করেন, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখেন।
তার খবরে আমি স্বস্তি পেলাম না। আমি নিজেই কিছু পাথেয় নিয়ে মক্কায় চলে গেলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে রাসূল সা.-কে চিনতে পেলাম না। কারো কাছে জিজ্ঞেস করারও সাহস পেলাম না। যমযমের পানি পান করে মসজিদুল হারামে বসে রইলাম।
উসমান রা. ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যেভাবে
আমাকে দেখে আলী রা. বললেন, আপনাকে অচেনা মনে হচ্ছে। আমি বললাম, জী হাঁ। তিনি আমাকে মেহমান বানিয়ে নিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। কিন্তু মক্কায় আসার কারণ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলেন না, আমি কিছু বললাম না।
পরদিন সকালে আবারো মসজিদুল হারামে গেলাম। ভেবেছিলাম, রাসূল সা.-এর সঙ্গে দেখা হবে অথবা কাউকে জিজ্ঞাসা করে তার সম্পর্কে জেনে নেবো। কিন্তু কেউ আমাকে তার সম্পর্কে জানালো না।
সন্ধ্যায় আবার আলী রা.-এর সঙ্গে দেখা হলো। আমি আমার কাঙ্খিত ঠিকানা খুঁজে পাইনি ভেবে তিনি আমাকে আবারো তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তবে সেদিন তিনি আমার কাছে মক্কায় আসার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলেন।
আমি তাকে বললাম, আপনি যদি কথাটা গোপন রাখেন তাহলে আমি বলতে পারি। তিনি আমাকে অভয় দিলেন।আমি তাকে বললাম,
আমি জানতে পেরেছি মক্কায় এক ব্যক্তি নিজেকে নবী দাবি করেছেন, আমি আমার ভাইকে তার সম্পর্কে জানতে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু সে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেনি। তাই আমি নিজেই চলে এসেছি।
সব শুনে আলী রা. বললেন, আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। চলুন আমার সঙ্গে। আমি যেখানে প্রবেশ করবো আপনি সেখানে প্রবেশ করবেন। যাওয়ার পথে কোনো আমাদের সন্দেহ করছে এমন আশঙ্কা হলে আমি আশপাশের কোনো দোকানের পাশে গিয়ে জুতা ঠিক করার ভান করবো। তখন আপনি নিজের মতো করে পথ চলবেন। এরপর আমি আলী রা.-এর সঙ্গে রাসূল সা.-এর কাছে গেলাম।
রাসূল সা.-এর কাছে গিয়ে আমি ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আমি আমার সামনে ইসলাম উপস্থাপন করলেন। আমি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেলাম।
আল্লাহর রাসূল সা. আমাকে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রেখে নিজ গোত্রে ফিরে যেতে বললেন। এবং বললেন, যখন আমরা প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করবো তখন তুমি আমাদের সঙ্গে দেখা করবে।
আমি আল্লাহর রাসূল সা.-কে বললাম, সেই সত্তার শপথ, যিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমি কাফেরদের সামনে প্রকাশ্যে আমার ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা করবো।
এরপর আমি কাবাঘরের সামনে গেলাম। সেখানে উপস্থিত কুরাইশদের সামনে আমি ঘোষণা দিলাম—
তোমরা শোনো আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
এই ঘোষণা শোনার পর কুরাইশরা আমাকে বেদ্বীন বলে সম্বোধন করে এমন মারধর শুরু করলো যে, আমি ভেবেছিলাম আমি হয়তো মরেই যাবো।
এ সময় আব্বাস রা. এগিয়ে এসে আমাকে রক্ষা করলেন। আমার দিকে একটু ভালোভাবে ঝুঁকে দেখে তিনি বললেন,
এই লোক তো গেফার গোত্রের। তোমরা এ গোত্রের এলাকার ওপর দিয়েই ব্যবসা করতে যাও। একথা শুনে তারা আমাকে ছেড়ে দিল। পরদিনও আমি কাবার সামনে গিয়ে আবার ইসলাম ও নবীজির ওপর ঈমান আনার সাক্ষ্য দিলাম। তারা আবারো আমাকে মারধর করলো, আবারো আব্বাস রা. আমাকে তাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা করলেন।
(বুখারি, ১/৪৪৯, ৫৪৪-৫৪৫, আর রাহীকুল মাখতুম, ১৪৮)
পাঠকের মতামত